বাংলা উপন্যাস, সিনেমা কিংবা নাটকে সিঁধেল চোরের উপস্থিতি যেন এক রহস্যময় চরিত্র। বিংশ শতাব্দীতেও সিঁধেল চোর ছিল গ্রামবাংলার মানুষের জন্য এক আতঙ্কের নাম। তবে এখন আর তাদের দেখা মেলে না। সময়ের স্রোতে সিঁধেল চোরেরা ইতিহাস হয়ে গেছে। কিন্তু তারা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি-লোককথায়, গল্পে, স্মৃতিতে আজও টিকে আছে তাদের উপস্থিতি।
সেইসব চোরেরা রাতের আঁধারে তেলতেলে শরীর নিয়ে, মুখে ভুসি মেখে, ছোট গামছা বা ধুতি শক্ত করে বেঁধে বেরিয়ে পড়ত অভিযানে। তাদের কাছে থাকত এক যন্ত্র-‘সিঁধকাঠি’। কামারশালায় তৈরি হওয়া এই লৌহদণ্ড দেখতে ছিল অনেকটা ছোট শাবলের মতো। এর সাহায্যে তারা মাটি ও ইট ধীরে ধীরে সরিয়ে তৈরি করত গর্ত-সিঁধ। আর সেই গর্ত দিয়েই তারা গৃহে প্রবেশ করত।
গ্রামবাংলায় তখন একটা কথা ছিল খুব প্রচলিত-‘চোরে কামারে দেখা নেই/সিঁধকাঠি তৈরি আছে।’ অর্থাৎ চোর দেখা না গেলেও তার অস্ত্র ঠিকই প্রস্তুত।
চোরেরা এতটাই অভিজ্ঞ ছিল যে গৃহস্থের নিঃশ্বাসের ওঠানামা থেকেই বুঝে নিত ঘুম কতটা গভীর। তবে একবার যদি কেউ টের পেত, তবে তাদের কাজ শেষ! অতএব তারা বেছে নিত পা দিয়ে আগে ঢোকা, যাতে মাথায় কোপ পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এক গল্পে তো বলা হয়, এক বাড়ির বউ রামদা হাতে অপেক্ষা করছিল। চোর মাথা না ঢুকিয়ে পা ঢোকাতেই সে রেহাই পায়।
অনেক সময় ধরা পড়ার ভয় পেয়ে পালাত জঙ্গলে কিংবা শীতল পুকুরে। কেউ কেউ মাথায় মাটির হাঁড়ি চাপিয়ে পুকুরে ভেসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে সব চোরেরই ভাগ্য এমন সুপ্রসন্ন ছিল না—কেউ ধরা পড়ত, কেউ মার খেত, কেউ আবার কৌতুকের পাত্র হয়ে উঠত।
আমার শৈশবের এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা ছিল এই সিঁধেল চোর দেখা। তখন ফাইভে পড়ি। শীতের এক সকালে নানাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে জীবনের প্রথম সিঁধেল চোর দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। নানাবাড়ির বাৎসরিক শীতকালীন মিলনমেলায় সবাই মেতে আছে-মামা, খালা, ভাইবোন, শহর থেকে আসা অতিথিরা। আর এর মধ্যেই সুযোগ খুঁজে এসেছিল এক সিঁধেল চোর।
ফজরের নামাজের ঠিক আগে হৈচৈ শুরু হয়। ঘুম ভেঙে শুনি, পাশের বাড়িতে চোর ধরা পড়েছে। গিয়ে দেখি, মেঝ মামার ঘরের পেছনের মাটির মেঝেতে বড়সড় একটা গর্ত। সেখান দিয়েই চোর ঢুকে ঘরের আলমারি ভেঙে জামাকাপড়, টাকা-পয়সা, গহনা নিয়েছে। কিন্তু বের হওয়ার সময়ই ধরা পড়ে গেছে। হয়তো কাজটা করতে করতে ভোর হয়ে গিয়েছিল, আর নামাজে যাওয়ার পথে কিছু মানুষ তাকে দেখে ফেলে।
আমরা সেই সিঁধ দেখে অদ্ভুত এক উচ্ছ্বাসে নেচে উঠলাম। আমি তখন ভাবলাম, এই গর্ত দিয়ে ঢুকে যদি একবার ঘরের মধ্যে ঢোকা যায়! সেই রোমাঞ্চে আমি সত্যিই গর্ত বেয়ে ঢুকে পড়লাম ঘরের ভেতরে। মামাতো ভাইবোনদের সামনে ধরা পড়তেই বড় ভাই চেঁচিয়ে উঠলো, “চোর! চোর!” সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কিন্তু মামির ধমকে শেষমেশ দৌড়ে পালাতে হলো।
তারপর গেলাম সেই চোরকে দেখতে। বৈঠকখানার মাঝের থামের সাথে বাঁধা এক নাদুসনুদুস লোক। লুঙ্গি কাঁছা দেওয়া, শরীর জুড়ে মাটির ছাপ, কিন্তু মুখে তেলচকচকে ভাব। সেই দৃশ্য দেখে আমি হঠাৎ এক অনুভবে আচ্ছন্ন হলাম-এ তো মানুষ! একসময় যে ভাবতাম চোর মানেই শিংওয়ালা কোনো ভিন্ন প্রাণী, সেই ভুলও ভাঙল সেদিন। বাবার কোলে বসে জানতে পারলাম, চোরের আসলে শিং থাকে না, তারা আমাদের মতোই মানুষ। শুধু পথটা ভুল।
পরদিনও আমি ওই সিঁধটা দেখতে যেতাম। মনে হতো, কি এক শিল্প এই চুরি! এ যেন গুহা খননের মতো, এক ধরনের রুদ্ধশ্বাস অভিযান! আস্তে আস্তে মনে হচ্ছিল, বড় হয়ে আমিও বুঝি সিঁধেল চোর হবো! কিন্তু সময় বদলাতে থাকল। কাঁচা মাটির ঘরের জায়গায় একে একে উঠে গেল পাকা দালান, সিমেন্টের দেয়াল, লোহার গেট। সিঁধেল চোরেরা সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। তারা হারিয়ে গেল, রয়ে গেল শুধু গল্পে, স্মৃতিতে, আর মাঝেমধ্যে ফিরে আসা শৈশবের সেই রোমাঞ্চে।
এখন ভাবি, কতটা বুদ্ধি, ধৈর্য আর সাহস থাকলে কেউ এমন চুরি করতে পারে! সিঁধেল চুরি ছিল একধরনের কৌশলী আর অভিনব চুরিশিল্প, যা আজ বিলুপ্তির পথে। অথচ বাংলার লোককথায়, শিশুমনে, আর হারিয়ে যাওয়া এক সময়ের গ্রাম্য জীবনে তাদের স্থান ছিল একেবারেই আলাদা।
সোহাইল আহমেদ
গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক