সোহাইল আহমেদ
৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এই দিনটি শুধু একটি আন্তর্জাতিক দিবস নয়, এটি একটি আদর্শ, যা মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং জনগণের জানার অধিকারকে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে এই দিনের তাৎপর্য দিন দিন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো রাষ্ট্রীয় আয়োজন নেই, নেই সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কার্যকর বার্তা কিংবা সুরক্ষার নিশ্চয়তা। বরং এই দিন যেন সাংবাদিক সমাজের জন্য এক আত্মবিশ্লেষণের উপলক্ষ—সত্য বলা কি তবে এই দেশে অপরাধ?
বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বাকস্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, এই অধিকার বারবার পদদলিত হচ্ছে। সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, মামলা-মোকদ্দমার বেড়াজালে বন্দি হচ্ছেন, এমনকি প্রাণ হারাচ্ছেন। বিগত কয়েক বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ সাংবাদিক দমনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সত্য প্রকাশের আগেই সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে, যার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা মারাত্মক হুমকির মুখে।
এ বাস্তবতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর ২০২৪ সালের প্রেস ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশ ১৬৩তম অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াতেও আমরা পিছিয়ে। এমনকি পাকিস্তান, আফগানিস্তানের চেয়েও নিচে আমাদের অবস্থান, যা নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক। এই সূচকের মানদণ্ডে স্পষ্ট হয়েছে—তথ্য গোপন, সরকারি নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিজ্ঞাপন ও আইনি চাপে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ—এসব মিলেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা ২০১৮ সালে চালু হয় এবং ২০২৩ সালে নাম বদলে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ হয়—আসলে নামের পরিবর্তন ছাড়া কার্যত কোনো স্বস্তি আনেনি। বরং এতে সাংবাদিকদের হয়রানি আরও নানামুখী ও সুসংগঠিত হয়েছে। ‘গুজব ছড়ানো’, ‘রাষ্ট্রবিরোধিতা’, ‘মানহানিকর বক্তব্য’—এসব অস্পষ্ট অভিযোগে মামলা দিয়ে ভয় দেখানোর সংস্কৃতি এখন রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা।
একটি স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র কখনোই টিকে থাকতে পারে না। কারণ জনগণ যদি জানতে না পারে—তাদের জন্য কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে, কারা দোষী—তবে তারা কিভাবে সচেতন নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখবে? গণমাধ্যমের কাজ সত্য তুলে ধরা, প্রশ্ন তোলা এবং বিতর্ক সৃষ্টি করা। আর এই বিতর্ক ও জবাবদিহিতার মধ্যেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিকশিত হয়। কিন্তু যখন এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, তখন গণতন্ত্র কেবল নামমাত্র থাকে—যা বাস্তবে নেই।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় যে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু দুঃখজনক নয়, ভয়ংকর বার্তা বহন করে। ২০১২ সালের সাগর-রুনি হত্যা মামলা আজও বিচার পায়নি। ২০২০ সালে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল নিখোঁজ থাকার পর কারাবন্দি হন। ২০২৩ সালে নওগাঁর সাংবাদিক বুলবুল আহমেদকে হত্যা করা হয় সংবাদ প্রকাশের কারণে। আর ২০২০ সালে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে গভীর রাতে তুলে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার ঘটনা তো রীতিমতো আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এসব ঘটনার বিচার না হওয়া ও অপরাধীদের রক্ষা পাওয়া রাষ্ট্রের নীরব অনুমোদনেরই বহিঃপ্রকাশ।
তথ্য অধিকার আইন থাকলেও বাস্তবে তথ্য পাওয়া যায় না। অধিকাংশ সময় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য ‘প্রক্রিয়াধীন’ বলে আবেদনগুলো ফেলে রাখে। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আরও বেশি। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বাধা দেওয়া হয়, সরকারি কর্মকর্তারা সাক্ষাৎকার দিতে ভয় পান। অর্থাৎ, তথ্য পাওয়ার অধিকার থাকলেও তা প্রয়োগযোগ্য নয়—কাগজে অধিকার থাকলেও বাস্তবে বাধা।
এই বাস্তবতা শুধু সাংবাদিকদের নয়, গোটা সমাজের জন্য হুমকি। কারণ যখন সত্য বলা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন পুরো সমাজ মিথ্যার জালে বন্দি হয়। যে রাষ্ট্রে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নেই, সেখানে জনগণের বাকস্বাধীনতাও নিরাপদ নয়। একটি ভয়ভীতি ও নিঃশব্দতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা নাগরিকদের আত্মবিশ্বাস ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে ধ্বংস করে দেয়।
তবে এর মাঝেও কিছু বিকল্প পথ রয়েছে—স্বাধীন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, নাগরিক সাংবাদিকতা, বিকেন্দ্রীভূত তথ্য প্রবাহ—যেগুলোর মাধ্যমে কিছুটা হলেও সত্য প্রকাশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হতে হলে রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা প্রয়োজন, দরকার একটি জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ও আইনের শাসন।
এই বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে আমাদের ভাবতে হবে—কীভাবে একটি সাহসী, স্বচ্ছ ও দমনমুক্ত গণমাধ্যম গড়ে তোলা যায়। কারণ, সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের আয়না। সেই আয়নায় যদি প্রতিচ্ছবি বিকৃত হয়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎও অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
সুতরাং, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, সমাজ এবং নাগরিকদের সম্মিলিতভাবে একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে—মুক্তচিন্তা রক্ষা করা, সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য। তবেই আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারবো।
লেখক : সোহাইল আহমেদ
কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক
সম্পাদক ও প্রকাশক: মোঃ রফিকুল ইসলাম লাভলু। উপদেষ্টা : প্রবাসী সুমন চন্দ্র। নির্বাহী সম্পাদক মোঃ তাজরুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক মোঃ জাহিদ হাসান মানছুর। ঢাকা অফিস : আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০।
যোগাযোগের ঠিকানা:-পীরগাছা, রংপুর। বার্তা কার্যালয়ঃ পাইকগাছা, খুলনা। মোবাইল: ০১৭১৭-৪৬৫০১০ ( সম্পাদক), ০১৭২৮-১০৩৫০৭ (নির্বাহী সম্পাদক