সৃষ্টিশীলতার গলা টিপে ধরলে জাতির ভবিষ্যৎ থেমে যায়
যেখানে সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ বাধাগ্রস্ত হয়, সেখানে জাতীয় চেতনার শিকড় শুকিয়ে যেতে থাকে। একটি রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিণতি নির্ভর করে তার লেখক, গবেষক, সাংবাদিক এবং চিন্তকের ওপরে—যারা জাতির আত্মার অনুবাদক। তারা কেবল সাহিত্যের ভাষা নির্মাণ করেন না; তারা প্রজন্মান্তরের বিবেকের উত্তরাধিকার রক্ষা করেন। অথচ আজ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর তীব্র ছায়াতলে এই প্রাজ্ঞ কণ্ঠসমূহ যেন ক্রমাগত নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে। যখন একটি শব্দ চয়নের আগে একজন লেখককে ভাবতে হয়—”এই বাক্য কি আমার মুক্তির বিনিময়ে আসবে?”, তখন আমাদের জাতীয় আত্মচিন্তা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
লেখার স্বাধীনতা: রাষ্ট্রের পরম্পরাগত দায় না আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণ?
লেখা মানে কেবল রূপক, কবিতা বা গল্প নয়; এটি সমাজের অন্তর্গত বেদনা, প্রতিবাদ, প্রশ্ন এবং বিপ্লবের ভাষ্য। লেখক রাষ্ট্রের প্রতিপাল্য নন—তারা রাষ্ট্রের সমালোচনাকারী বিবেক। আধুনিক রাষ্ট্রের স্বরূপ নির্ধারণ করে তার নাগরিকদের কতটা স্বাধীনভাবে ভাবতে ও প্রকাশ করতে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা হলো—লেখকের স্বাধীনতা এখন নিয়ন্ত্রিত, পর্যবেক্ষণাধীন এবং প্রায়শই দমনযোগ্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নির্দিষ্ট ধারাসমূহ—বিশেষত ২১, ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারা—এমনভাবে শব্দচয়নে গঠিত হয়েছে, যেখানে “গুজব”, “ভীতি”, “অপমান”, “মানহানি”, কিংবা “জনমনে বিভ্রান্তি”—এই শব্দগুলোর অপব্যাখ্যার সুযোগ এতটাই বিস্তৃত যে, ন্যায়বিচারের সংজ্ঞাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
এই আইনি অস্পষ্টতা একদিকে যেমন নির্বাহী ক্ষমতার ইচ্ছানুযায়ী ব্যাখ্যার পথ সুগম করে, অন্যদিকে তা বিচারবর্গের নিরপেক্ষতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। ফলত, কোনও সাহসী কলম, যা রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটি চিহ্নিত করে, তা অবলীলায় ফৌজদারি অভিযোগে পরিণত হয়। একটি সমাজ তখনই বিকল হয়, যখন সত্য উচ্চারণ দণ্ডনীয় হয়ে পড়ে।
আইনের ছদ্মবেশে মুক্তচিন্তার নিধন: সংবিধান বনাম বাস্তবতা
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—প্রত্যেক নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও বিবেকের স্বাধীনতা থাকবে। তবে সেখানে নির্দিষ্ট কিছু যৌক্তিক সীমাবদ্ধতার কথাও বলা হয়েছে—যেমন জনশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শালীনতা ইত্যাদি। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলোর ভাষাগত গরমিল ও প্রসারণ এতটাই অনির্দিষ্ট যে তা সংবিধানিক রক্ষাকবচ ভেদ করে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বৈধতা তৈরি করে। একদিকে সংবিধান মুক্তচিন্তার প্রতিশ্রুতি দেয়, অপরদিকে একটি বিতর্কিত আইন সেই স্বাধীনতাকে অনায়াসে শিকল পরায়—এটি একটি সাংবিধানিক দ্বৈততার নজির।
এই আইনের অপব্যবহারের বহু প্রমাণ রয়েছে—বিনা তদন্তে মামলা গ্রহণ, জামিন অস্বীকৃতি, সাংবাদিকদের মাসের পর মাস আটকে রাখা, এমনকি চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত করা। আদালতের নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রায়শই নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলে যাওয়া আচরণ, বিচারব্যবস্থার আত্মনির্ভরতা ও স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে, আইন হয়ে ওঠে প্রতিশোধের অস্ত্র—ন্যায়বিচারের হাতিয়ার নয়।
বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও লেখক-সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে চলমান বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮। এই আইনটি প্রণয়নের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে লেখক, সাংবাদিক ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে এর প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
মুশতাক আহমেদ: কারাগারে মৃত্যু
লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২০ সালের মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ফেসবুকে সরকারবিরোধী পোস্ট দেওয়ার। প্রায় ১০ মাস কারাবন্দি থাকার পর ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
আহমেদ কবির কিশোর: নির্যাতনের অভিযোগ
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর একই মামলায় গ্রেপ্তার হন এবং দীর্ঘ সময় কারাবন্দি ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। মুক্তির পর তিনি জানান, গ্রেপ্তারের পর তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে, যার ফলে তাঁর শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে।
রোজিনা ইসলাম ও আরিফুল ইসলাম: সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম ২০২১ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রিপোর্টিং করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি নথি চুরির অভিযোগ আনা হয়, যা সাংবাদিক সমাজে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। আরিফুল ইসলাম, কুড়িগ্রামের সাংবাদিক, ২০২০ সালে গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা পরে বাতিল করা হয়।
হিমেল হোসেন ও মাকসুদুল মিলন: তরুণদের ওপর চাপ
তরুণ লেখক ও সাংবাদিক হিমেল হোসেন ও মাকসুদুল মিলন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী মন্তব্য করা। এই ঘটনাগুলো তরুণ সমাজে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ বনাম বাস্তবতা
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা, যেমন ২১, ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১, এই স্বাধীনতাকে সীমিত করে। এই ধারাগুলোর ভাষা অস্পষ্ট, যা আইনের অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে।
করণীয়: একটি মানবিক ও যুক্তিবাদী রাষ্ট্র নির্মাণে নীতিগত সংস্কার
১. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের আলোকে পর্যালোচনা ও সংস্কার করতে হবে।
২. লেখকদের বিরুদ্ধে মামলা করার পূর্বে ‘লেখা মূল্যায়ন ট্রাইব্যুনাল’ নামক একটি নিরপেক্ষ বোর্ডের মতামত বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩. ‘লেখক সুরক্ষা পরিষদ’ গঠনের মাধ্যমে লেখকদের আইনি ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, আইনবিদ ও রাষ্ট্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একাধিক ফোরাম গঠন করে মতপ্রকাশের ন্যায়সঙ্গত সীমারেখা নির্ধারণ করতে হবে।
৫. সাংবাদিকতা, ব্লগিং ও সাহিত্যিক চিন্তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে সমাজের বিবেক বিকশিত হয় ভয় নয়।
৬. আইনের অপব্যবহারের জন্য দায়ী সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি। লেখক ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আমরা একটি মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ: কোথায় আমাদের অবস্থান?
বিশ্বব্যাপী যেখানে মতপ্রকাশের অধিকারে সম্প্রসারণ ঘটছে, সেখানে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে প্রথম সংশোধনী মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে একটি অখণ্ড অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভারতে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালে “Section 66A” কে বাতিল করে জানিয়ে দেয়—”অস্পষ্টতা কখনো আইন হতে পারে না।” অথচ বাংলাদেশে এখনো এমন একটি আইন কার্যকর, যা সৃজনশীল চর্চাকে অপরাধে পরিণত করে।
Human Rights Watch, Amnesty International এবং Reporters Without Borders একাধিকবার বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘draconian’ আখ্যা দিয়েছে এবং এর সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে।
লেখকের ভূমিকা: আরাধ্যতা নয়, আর্তি ও আর্তনাদ
একজন লেখক রাষ্ট্রের দাস নন, তিনি জাতির ব্যথা শোনার যন্ত্র। তার দায়িত্ব ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনার পাশাপাশি সমাজের কাঁটাগুলোও চিহ্নিত করা। রাষ্ট্র যদি কেবল প্রশংসা সহ্য করতে পারে, কিন্তু সমালোচনায় ক্ষিপ্ত হয়, তবে তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়—তা হয়ে ওঠে আত্মম্ভরিতার বলয়। লেখককে যদি শাস্তির শিকার হতে হয়, তবে ভবিষ্যতের ইতিহাস বিকৃত হবে। এবং সাহস—যা লেখকের অস্তিত্বের মূলে থাকে—তা হয়ে পড়বে একটি বিলুপ্তপ্রায় শব্দ।
সাহসী কলমই জাতির শিরদাঁড়া
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেবলমাত্র একটি আইন নয়—এটি রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যকার বিশ্বাসের সূচক। যখন এই আইনটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে, তখন তা রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে। একটি জাতি তখনই ভবিষ্যতমুখী হয়, যখন তার লেখক স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে। কলমে শেকল পরিয়ে উন্নয়নের গল্প বলা যায় না; উন্নয়নের সত্যতা যাচাই করাও রাষ্ট্রচিন্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আমরা চাই—একটি এমন রাষ্ট্র, যেখানে লেখার অর্থ হবে মুক্তচিন্তার বহিঃপ্রকাশ, সাহসের উদ্ভাস, আর প্রতিবাদের ভাষা। কারণ, লেখকের কণ্ঠ যদি নিঃস্তব্ধ হয়, তবে সমাজ অন্ধকারে হারিয়ে যায়। এবং যিনি সত্য বলেন, ইতিহাস তার নাম কখনো ভুলে না।
সাংবাদিক বা লেখক: ‘বিপদ’ নয়, ‘সম্পদ’
একজন লেখক বা সাংবাদিকের কলম কেবল কালি নয়—তা হয়ে উঠতে পারে সমাজের ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যচিহ্ন, অবহেলিতের কণ্ঠস্বর, দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচনের মাধ্যম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যখন একটি রাষ্ট্র তাদের প্রশ্ন বা সমালোচনাকে “বিপদ” হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন সমাজ তার আত্মসমালোচনার ক্ষমতা হারায়।
একটি সচেতন রাষ্ট্র জানে—সাংবাদিকতা নিছক তথ্য পরিবেশন নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশ। একটি রিপোর্ট যদি রাষ্ট্রের ভুল তুলে ধরে, সেটি রাষ্ট্রদ্রোহ নয় বরং রাষ্ট্রগঠনে সহায়ক সতর্কতা।
নিরাপত্তা নিশ্চিতের নামে যদি লেখকের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সাংবাদিকের কণ্ঠরোধ করা হয়, তবে সেটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নয়—আসলে ভবিষ্যতের অন্ধকার ডেকে আনা।
তাই সাংবাদিক বা লেখকের ভূমিকা যতখানি সাহসী হওয়া প্রয়োজন, রাষ্ট্রের ভূমিকাও হওয়া উচিত ততটাই সহনশীল ও দায়িত্বশীল। তাদের “নিয়ন্ত্রণ” নয়, “সহযোগিতা” করা উচিত। কারণ, তারা রাষ্ট্রের শত্রু নয়—তারা রাষ্ট্রের চোখ, কান ও বিবেক।
সোহাইল আহমেদ || কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক