প্রতিবছর ২০ জুন বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব শরণার্থী দিবস (World Refugee Day)—একটি এমন দিন, যেটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেইসব মানুষের কথা, যারা যুদ্ধ, নিপীড়ন, জাতিগত দাঙ্গা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে হয়ে উঠেছে আশ্রয়প্রার্থী। এই দিনটি শুধু করুণা জানানোর নয়, বরং বিশ্ববাসীর কাছে এক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরে: আমরা কি শরণার্থীদের মানুষ হিসেবে দেখতে শিখেছি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট এক প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হয়ে উঠে আসে। কারণ, মানবতার নাম করে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি বটে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের খেলায়।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর শুরু হয় রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ ও গ্রামপোড়ানোর নিষ্ঠুরতা। জীবন বাঁচাতে সেই দুঃসময়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। কিন্তু আশ্রয় পাওয়া মানেই কি নিরাপদ জীবন? না, বরং এখান থেকেই শুরু হয় এক নতুন দুর্ভোগের অধ্যায়—অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ, বন্দীজীবন, আর রাষ্ট্রহীনতার যন্ত্রণা।
বর্তমানে কক্সবাজার ও ভাসানচরের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস্তবতাটা যেন দাঁড়িয়েছে—জীবিত থেকেও অদৃশ্য থাকার এক চিরস্থায়ী অবস্থান! তাদের অনেকেই এখানে জন্ম নিচ্ছে, বড় হচ্ছে, আবার মৃত্যুবরণ করছে—কোনো জন্মসনদ বা পরিচয়পত্র ছাড়াই।
এই অবস্থাটা শুধু রোহিঙ্গাদের জন্যই ভয়াবহ নয়, এটি বাংলাদেশের জন্যও এক বিশাল সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত চাপ তৈরি করছে। প্রশ্ন হলো—এই দায় কার? শুরুতে বাংলাদেশের মানবিক উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হলেও, বর্তমানে রোহিঙ্গা ইস্যুটা পরিণত হয়েছে এক বোঝায়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে, পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, এমনকি মাদক পাচার ও অপরাধ কর্মকাণ্ডেও রোহিঙ্গাদের একাংশ জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ উঠছে।
কিন্তু বিষয়টা এখানেই থেমে নেই। এই সংকট যখন ঘনীভূত হচ্ছে, তখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের ভূমিকা কেমন?
দুঃখজনকভাবে, আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা এককথায় নিরুত্তাপ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা ওআইসি সবাই রোহিঙ্গা সংকটে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তহবিল দিয়েছে, কিন্তু কার্যকর সমাধান আদায়ের পথে বাস্তব চাপ সৃষ্টি করেনি। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে জাতিসংঘে কোনো কড়া প্রস্তাব পাশ হয়নি।
এদিকে মিয়ানমার সরকারও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কার্যত অনাগ্রহী। একাধিক প্রত্যাবাসন চুক্তি হলেও, সেগুলোর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। ফলাফল? রোহিঙ্গারা আজ আটকে আছে—না তারা বাংলাদেশের নাগরিক, না মিয়ানমারের।
তাদের জীবনে এখন একটাই পরিচয়—”শরণার্থী”। কিন্তু শরণার্থীত্ব কি চিরস্থায়ী হতে পারে?
বিশ্ব শরণার্থী দিবসের মূল আহ্বান হলো: “Refugees are people, not problems.” কিন্তু আমরা কি সত্যিই তা বিশ্বাস করি? তাদেরকে বোঝা হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ছে, অথচ তাদের দুঃখ-কষ্ট, নিরাপত্তাহীনতা ও ভবিষ্যতের অন্ধকার যেন আমাদের মনেই পড়ে না।
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী?
প্রথমত, রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলকে আরও সক্রিয় হতে হবে। কেবল বক্তৃতা নয়, বাস্তব কূটনৈতিক চাপ এবং আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, মানসিক সহায়তা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা জরুরি, যাতে একটি বিপথগামী প্রজন্ম গড়ে না ওঠে।
তবে কেবল রাষ্ট্রীয় স্তরেই নয়, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষক, সাংবাদিক ও তরুণদেরও সামনে আসতে হবে। আমাদের মানবিক অনুভবই পারে এই সংকটকে আলোকিত করতে—সচেতনতা, সহানুভূতি ও সাহস দিয়ে।
বিশ্ব শরণার্থী দিবস আমাদের একটি বার্তাই দেয়: মানুষ যখন নিজের ঘর হারায়, তখন আমরা তার জন্য নতুন আশার একটা দরজা খুলে দিতে পারি। সেটাই আমাদের মানবিক দায়িত্ব—এবং সেই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই আমরা সত্যিকারের সভ্যতা দাবি করতে পারি।
আজ ২০ জুন, এই দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক—শরণার্থীদের কোনোদিন ‘অপর’ ভাববো না। তাদের দুর্ভোগে পাশে দাঁড়ানো, কণ্ঠস্বর দেওয়া, এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাধানে ভূমিকা রাখাই হবে আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্মান।
লেখক: সোহাইল আহমেদ
গণমাধ্যমকর্মী, কলামিস্ট, শিক্ষক ও সংগঠক।